এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স একটি বহুমাত্রিক সমস্যা যা বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য একটি বৈশ্বিক হুমকি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। বহুমাত্রিক এই সমস্যা সমাধানে মানবস্বাস্থ্য, প্রাণিস্বাস্থ্য এবং বাস্তুসংস্থান সম্পর্কিত স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনার সমন্বয়ে গঠিত ‘ওয়ান হেলথ’ প্লাটফরমটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
সুপার বাগ (Super Bag) বা মাল্ট্রি ড্রাগ রেজিস্টেন্স অরগানিজম (MDRO) কী?
কোন জীবাণু যখন একই সাথে অনেকগুলো এন্টিবায়োটিক এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয় তখন তাকে সুপার ব্যাগ বা মাল্ট্রি ড্রাগ রেজিস্টেন্স অরগানিজম (MDRO) বলে। আর যখন কোন ব্যক্তি বা প্রাণি এরূপ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং উক্ত জীবাণুর প্রতি সংবেদনশীল কোন এন্টিবায়োটিক না থাকে তখন তাকে আর রক্ষা করা যায় না, যার ফলে মৃত্যু অবধারিত হয়ে যায়।
এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স (AMR) কী?
কোন জীবাণু এন্টিমাইক্রোবিয়ালস (এন্টিবায়োটিক) এর প্রতি সংবেদনশীলতা হারিয়ে ফেললে বা এন্টিমাইক্রোবিয়ালস (এন্টিবায়োটিক) এর প্রতি প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে সক্ষম হলে উক্ত এন্টিমাইক্রোবিয়ালস (এন্টিবায়োটিক) দিয়ে উক্ত জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট কোন রোগের চিকিৎসা ফলপ্রসূ হয় না বা রোগীকে সুস্থ করা যায় না, জীবাণুর এই পরিবর্তনকে এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স (AMR) বলে।
এন্টিমাইক্রোবিয়াল এবং এন্টিবায়োটিক কী?
এন্টিমাইক্রোবিয়ালস এক প্রকার জৈব বা অজৈব উপাদান যা এক বা একাধিক জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করে জীবাণুর কার্যকারিতা নষ্ট করতে সক্ষম, জীবাণু ঘটিত নানা রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। যেমন, পেনিসিলিন, টেট্রাসাইক্লিন, মেট্রোনিডাজল ইত্যাদি। এদের মধ্যে যে সমস্ত উপাদান শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর তাদেরকে এন্টিবায়োটিক বলে। যেমন, পেনিসিলিন, জেন্টামাইসিন, স্ট্রেপ্ট্রোমাইসিন ইত্যাদি।
এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স (AMR) কি আমাদের জন্য ক্ষতিকর? ক্ষতিকর হলে কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে?
হ্যাঁ, এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স (AMR) প্রপঞ্চটি আমাদের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। এন্টিমাইক্রোবিয়ালস বিভিন্ন প্রকার রোগসৃষ্টিকারী জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করে মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করে। যদি প্রতিনিয়ত এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স তৈরি হতে থাকে তবে অদূর ভবিষ্যতে জীবাণু ঘটিত রোগ চিকিৎসার জন্য কার্যকর কোন ওষুধ পাওয়া যাবে না, ফলশ্রুতিতে অতি সাধারণ রোগেই অনেক মানুষ সহ প্রাণিকূল এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে। ২০১৬ সালে এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স (AMR) জন্য পৃথিবীতে সাত লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। আমরা এখনই যদি এই ব্যাপারে কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করি তবে আগামী ২০৫০ সালে ১ কোটি মানুষ মারা যাবে। মানবজাতি প্রায় ১০০ বছর পূর্বে যখন এন্টিমাইক্রোবিয়ালস ছিলো না তখন যে রূপ সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলো AMR ফলে আমরা আবার সেই যুগে ফিরে যাব এবং সামান্য অসুস্থতার কাছে অসহায় আত্নসমরপন করতে বাধ্য হবো।
এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স (AMR) কেন এবং কিভাবে হয়?
বিংশ শতাব্দীতে এন্টিবায়োটিকের আবিষ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ দ্বার উন্মোচন করেছে। আদ্যোবদি এই এণ্টিবায়োটিক লাখ লাখ মানুষের জীবন রক্ষা করে ছলেছে। তবে এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স (AMR) একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যখন থেকে জীবাণুর বিরুদ্ধে এন্টিমাইক্রোবিয়ালস ব্যবহার হয়ে আসছে তখন থেকেই এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স (AMR) শুরু হয়েছে। এন্টিমাইক্রোবিয়াল/এন্টিবায়োটিক এর মাত্রারিক্ত ব্যবহার এবং অপব্যবহার এই এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স (AMR) প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে।
মানব সৃষ্ট যে সকল কাজ (AMR) এর জন্য দায়ি তা হল-
১. ব্যবস্থাপত্রে অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয় এন্টিবায়োটিকস এর উপদেশ দেওয়া।
২. রোগী বা খামারী কতৃক এন্টিবায়োটিক পূর্ণ কোর্স ব্যবহার না করা।
৩. মানুষ, পশু-পাখি এবং মাছের চিকিৎসায় মাত্রারিক্ত এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা।
৪. প্রাণিসম্পদ এবং মৎস্যে ওজন বর্ধক (Growth Promoter) হিসেবে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা।
৫. রোগী বা খামারী কতৃক ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই যথেস্বাচারভাবে এন্টিবায়োটিকের ক্রয়-বিক্রয় করা।
৬. হাসপাতাল গুলোতে সঠিকভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম পরিচালনা না করা।
৭. ব্যক্তি পর্যায়ে যথাযথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং খামারি পর্যায়ে জীব-নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত না করা।
৮. এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স (AMR) সম্পকে জনসচেতনতার অভাব।
এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স (AMR) ভয়াবহতা থেকে বাঁচার উপায় কী?
উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পেলাম বিংশ শতাব্দীর চিকিৎসা বিজ্ঞানের আশীর্বাদ, এন্টিমাইক্রোবিয়ালস আমদের অসচেতনতা এবং যথোচ্ছচার ব্যবহারের কারনে অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। তাই একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানকে মানব সভ্যতার ঢাল হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে এন্টিমাইক্রোবিয়ালস এর অপব্যবহার এবং মাত্রারিক্ত ব্যবহার থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স (AMR) এর ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে নিম্নবর্ণিত সুপারিশ সমূহ বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন-
১. সংক্রামক রোগের (Infectious Diseases) চিকিৎসায় যতদূর সম্ভব স্বল্প বর্ণালীর (Narrow spectrum) এন্টিমাইক্রোবিয়ালস/এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা। সাধারণ চিকিৎসায় (Imperial treatment) এর ক্ষেত্রে Access গ্রুপের এন্টিমাইক্রোবিয়ালস/এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা। সম্ভব হলে জীবাণুর কালচারাল সেন্সিটিভিটি পরীক্ষা করে সুনির্দিষ্ট এন্টিমাইক্রোবিয়ালস/এন্টিবায়োটিক এর ব্যবহার করা।
২. সঠিক মাত্রায় এন্টিমাইক্রোবিয়ালস/এন্টিবায়োটিক এর পূর্ণ কোর্স ব্যবহার করা।
৩. ব্যবস্থাপত্র ব্যতীত এন্টিমাইক্রোবিয়ালস/এন্টিবায়োটিক এর বিক্রয় নিষিদ্ধ করা।
৪. প্রাণিসম্পদ এবং মৎস্যে ওজন বর্ধক (Growth Promoter) হিসেবে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা।
৫. ব্যক্তিপর্যায়ে যথাযথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং খামারী পর্যায়ে জীব-নিরাপত্তার ব্যাবস্থা নিশ্চিত করা।
৬. এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স (AMR) সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
ডা. মো. ওসমান গণি ( শিশির )
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ভেটেরিনারি পাবলিক হেলথ এন্ড মাইক্রোবায়োলজি শাখা,
প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মহাখালী, ঢাকা।